Madhab Jana
📞7548901565
সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল- আবোল তাবোল
- খিচুড়ি
- কাঠ-বুড়ো
- গোঁফ চুরি
- সৎ পাত্র
- প্যাঁচা আর প্যাঁচানি
- কাতুকুতু বুড়ো
- গানের গুঁতো
- খুড়োর কল
- লড়াই-ক্ষ্যাপা
- ছায়াবাজি
- কুম্ড়োপটাশ
- সাবধান
- বাবুরাম সাপুড়ে
- হাতুড়ে
- চোর ধরা
- অবাক কাণ্ড
- ভাল রে ভাল
- কিম্ভূত
- নেড়া বেলতলায় যায় ক’বার?
- বুঝিয়ে বলা
- শব্দকল্পদ্রুম
- বুড়ির বাড়ি
- বোম্বাগড়ের রাজা
- একুশে আইন
- হুঁকো মুখো হ্যাংলা
- দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম
- নারদ-নারদ
- কি মুস্কিল
- ভুতুড়ে খেলা
- ডানপিটে
- রামগরুড়ের ছানা
- আহ্লাদী
- হাত গণনা
- গন্ধ বিচার
- কাঁদুনে
- হুলোর গান
- ঠিকানা
- গল্প বলা
- নোট বই
- ভয় পেয়ো না
- ট্যাঁশ্ গরু
- ফস্কে গেল
- পালোয়ান
- বিজ্ঞান শিক্ষা
- খুচরো ছড়া
- আবোল তাবোল
আবোল তাবোল
আবোল তাবোল
আবোল তাবোল
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়, আয়রে পাগল আবোল তাবোল মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়। আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে নাইকো মানে নাইকো সুর, আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায় মন ভেসে যায় কোন সুদূর। আয় ক্ষ্যাপা-মন ঘুচিয়ে বাঁধন জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্, আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া নিয়মহারা হিসাবহীন। আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল মাতবি মাতাল রঙ্গেতে— আয়রে তবে ভুলের ভবে অসম্ভবের ছন্দেতে॥
খিচুড়ি
আবোল তাবোল
আবোল তাবোল
হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না), হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না। বক কহে কচ্ছপে— “বাহবা কি ফুর্তি! অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।” টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা— পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা? ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি, চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি! জিরাফের সাধ নাই মাঠে-ঘাটে ঘুরিতে, ফড়িঙের ঢঙ ধরি সেও চায় উড়িতে। গরু বলে, “আমারেও ধরিল কি ও রোগে? মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?” হাতিমির দশা দেখ— তিমি ভাবে জলে যাই, হাতি বলে, “এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই।” সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট— হরিণের সাথে মিলে শিং হল পস্ট।
কাঠ-বুড়ো আবোল তাবোল,হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে-যেন কে বৃদ্ধ, রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ। মাথা নেড়ে গান করে গুন্ গুন্ সংগীত— ভাব দেখে মনে হয় না-জানি কি পণ্ডিত! বিড়্ বিড়্ কি যে বকে নাহি তার অর্থ— “আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত।” টেকো মাথা তেতে ওঠে গায়ে ছোটে ঘর্ম, রেগে বলে, “কেবা বোঝে এ-সবের মর্ম? আরে মোলো, গাধাগুলো একেবারে অন্ধ, বোঝে নাকো কোনো কিছু খালি করে দ্বন্দ্ব। কোন্ কাঠে কত রস জানে নাকো তত্ত্ব— একাদশী রাতে কেন কাঠে হয় গর্ত?” আশে পাশে হিজি বিজি আঁকে কত অঙ্ক— ফাটা কাঠ ফুটো কাঠ হিসাব অসংখ্য; কোন্ ফুটো খেতে ভাল, কোন্টা বা মন্দ, কোন্ কোন্ ফাটলের কিরকম গন্ধ। কাঠে কাঠে ঠুকে করে ঠকাঠক শব্দ, বলে, “জানি কোন্ কাঠ কিসে হয় জব্দ। কাঠকুঠো ঘেঁটেঘুঁটে জানি আমি পষ্ট, এ কাঠের বজ্জাতি কিসে হয় নষ্ট। কোন্ কাঠ পোষ মানে, কোন্ কাঠ শান্ত, কোন্ কাঠ টিম্টিমে, কোন্টা-বা জ্যান্ত। কোন্ কাঠে জ্ঞান নাই মিথ্যা কি সত্য, আমি জানি কোন্ কাঠে কেন থাকে গর্ত।”গোঁফ চুরি আবোল তাবোলহেড আফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত, তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জান্ত? দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে, একলা বসে ঝিম্ঝিমিয়ে হটাৎ গেলেন ক্ষেপে! আঁৎকে উঠে হাত-পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল! হটাৎ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধ’রে তোল!” তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ-বা হাঁকে পুলিশ, কেউ-বা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।” ব্যস্ত সবাই এদিক-ওদিক করছে ঘোরাঘুরি— বাবু হাঁকেন, “ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!” গোঁফ হারানো! আজব কথা! তাও কি হয় সত্যি? গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমে নি এক রত্তি। সবাই তাঁরে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না, মোটেও গোঁফ হয় নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না। রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি, “কারো কথার ধার ধারি নে, সব ব্যাটাকেই চিনি। “নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা, “এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা। “এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই”— এই না বলে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়। ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়— “কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়। “আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর “গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল কেউ রাখে না খবর। “ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি, “মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি। “গোঁফকে বলে তোমার আমার— গোঁফ কি কারো কেনা? “গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।”সৎ পাত্র আবোল তাবোল,শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে— তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে? গঙ্গারামকে পাত্র পেলে? জানতে চাও সে কেমন ছেলে? মন্দ নয়, সে পাত্র ভালো— রঙ যদিও বেজায় কালো; তার উপরে মুখের গঠন অনেকটা ঠিক প্যাঁচার মতন। বিদ্যে বুদ্ধি? বলছি মশাই— ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়! উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামল শেষে। বিষয় আশয়? গরিব বেজায়— কষ্টে-সৃষ্টে দিন চলে যায়। মানুষ তো নয় ভাইগুলো তার— একটা পাগল, একটা গোঁয়ার; আরেকটি সে তৈরি ছেলে, জাল ক’রে নোট গেছেন জেলে। কনিষ্ঠটি তবলা বাজায় যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায়। গঙ্গারাম তো কেবল ভোগে পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে। কিন্তু তারা উচ্চ ঘর, কংসরাজের বংশধর! শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের কি যেন হয় গঙ্গারামের।— যাহোক এবার পাত্র পেলে, এমন কি আর মন্দ ছেলে?প্যাঁচা আর প্যাঁচানি আবোল তাবোল,প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি, খাসা তোর চ্যাঁচানি! শুনে শুনে আন্মন নাচে মোর প্রাণমন! মাজা-গলা চাঁচা সুর আহ্লাদে ভরপুর! গল-চেরা গমকে গাছ পালা চমকে, সুরে সুরে কত প্যাঁচ গিট্কিরি ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্! যত ভয় যত দুখ দুরু দুরু ধুক্ ধুক্, তোর গানে পেঁচি রে সব ভুলে গেছি রে— চাঁদামুখে মিঠে গান শুনে ঝরে দু’নয়ান
কাতুকুতু বুড়ো আবোল তাবোল,আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার, কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার! সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তার বাড়ি— কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি। কোথায় বাড়ি কেউ জানে না, কোন্ সড়কের মোড়ে, একলা পেলে জোর ক’রে ভাই গল্প শোনায় প’ড়ে। বিদ্ঘুটে তার গল্পগুলো না জানি কোন দেশী, শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি। না আছে তার মুণ্ডু মাথা না আছে তার মানে, তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে। কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে, গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে। কেবল বলে, “হোঃ হোঃ হোঃ, কেষ্টদাসের পিসি— বেচ্ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি। ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা, কচুর গায়ে রঙ-বেরঙের আল্পনা সব আঁকা। অষ্ট প্রহর গাইত পিসি আওয়াজ করে মিহি, ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চীঁহি।” এই না বলে কুটুৎ ক’রে চিম্টি কাটে ঘাড়ে, খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে। তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি, যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি।গানের গুঁতো আবোল তাবোল,গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা— আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা! গাইছে ছেড়ে প্রাণের মায়া, গাইছে তেড়ে প্রাণপণ, ছুটছে লোকে চারদিকেতে ঘুরছে মাথা ভন্ভন্। মরছে কত জখম হয়ে করছে কত ছট্ফট্— বলছে হেঁকে “প্রাণটা গেল, গানটা থামাও ঝট্পট্।” বাঁধন-ছেঁড়া মহিষ ঘোড়া পথের ধারে চিৎপাত; ভীষ্মলোচন গাইছে তেড়ে নাইকো তাহে দৃক্পাত। চার পা তুলি জন্তুগুলি পড়ছে বেগে মূর্ছায়, লাঙ্গুল খাড়া পাগল পারা বলেছে রেগে “দূর ছাই!” জলের প্রাণী অবাক মানি গভীর জলে চুপচাপ্, গাছের বংশ হচ্ছে ধ্বংস পড়ছে দেদার ঝুপ্ঝাপ্। শূন্য মাঝে ঘূর্ণা লেগে ডিগবাজি খায় পক্ষী, সবাই হাঁকে, “আর না দাদা, গানটা থামাও লক্ষ্মী।” গানের দাপে আকাশ কাঁপে দালান ফাটে বিল্কুল, ভীষ্মলোচন গাইছে ভীষণ খোশমেজাজে দিল্ খুল্। এক যে ছিল পাগলা ছাগল, এমনি সেটা ওস্তাদ, গানের তালে শিং বাগিয়ে মারলে গুঁতো পশ্চাৎ। আর কোথা যায় একটি কথায় গানের মাথায় ডাণ্ডা, ‘বাপ রে’ বলে ভীষ্মলোচন এক্কেবারে ঠাণ্ডা।খুড়োর কল আবোল তাবোল,কল করেছেন আজবরকম চণ্ডীদাসের খুড়ো— সবাই শুনে সাবাস বলে পাড়ার ছেলে বুড়ো। খুড়োর যখন অল্প বয়স— বছর খানেক হবে— উঠল কেঁদে ‘গুংগা’ বলে ভীষন অট্টরবে। আর তো সবাই ‘মামা’ ‘গাগা’ আবোল তাবোল বকে, খুড়োর মুখে ‘গুংগা’ শুনে চম্কে গেল লোকে। বল্লে সবাই, “এই ছেলেটা বাঁচলে পরে তবে, বুদ্ধি জোরে এ সংসারে একটা কিছু হবে।” সেই খুড়ো আজ কল করেছেন আপন বুদ্ধি বলে, পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘণ্টায় চলে। দেখে এলাম কলটি অতি সহজ এবং সোজা, ঘণ্টা পাঁচেক ঘাঁটলে পরে আপনি যাবে বোঝা। বলব কি আর কলের ফিকির, বলতে না পাই ভাষা, ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা। সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যেরকম রুচি— মণ্ডা মিঠাই চপ্ কাট্লেট্ খাজা কিংবা লুচি। মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে, মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে। এমনি করে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে, উত্সাহেতে হুঁস্ রবে না চলবে কেবল ধেয়ে। হেসে খেলে দু-দশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে, খাবার গন্ধে পাগল হয়ে জিভের জলে ভেসে। সবাই বলে সমস্বরে ছেলে জোয়ান বুড়ো, অতুল কীর্তি রাখল ভবে চণ্ডীদাসের খুড়ো।লড়াই-ক্ষ্যাপা আবোল তাবোল,ওই আমাদের পাগলা জগাই, নিত্যি হেথায় আসে; আপন মনে গুনগুনিয়ে মুচকি-হাসি হাসে। চলতে গিয়ে হঠাৎ যেন থমক লেগে থামে, তড়াক করে লাফ দিয়ে যায় ডাইনে থেকে বামে। ভীষণ রোখে হাত গুটিয়ে সামলে নিয়ে কোঁচা, ‘এইয়ো’ বলে ক্ষ্যাপার মতো শূন্যে মারে খোঁচা। চেঁচিয়ে বলে, “ফাঁদ পেতেছ? জগাই কি তায় পড়ে? সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে।” উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িংবিড়িং নাচে, কখনো যায় সামনে তেড়ে, কখনো যায় পাছে। এলোপাতাড়ি ছাতার বাড়ি ধুপুস্ধাপুস্ কত! চক্ষু বুজে কায়দা খেলায় চর্কিবাজির মতো। লাফের চোটে হাঁফিয়ে ওঠে গায়েতে ঘাম ঝরে, দুড়ুম করে মাটির পরে লম্বা হয়ে পড়ে। হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচায় খালি চোখটি ক’রে ঘোলা, “জগাই মোলো হঠাৎ খেয়ে কামানের এক গোলা!” এই না বলে মিনিট খানেক ছট্ফটিয়ে খুব, মড়ার মতন শক্ত হ’য়ে এক্কেবারে চুপ! তার পরেতে সটান বসে চুলকে খানিক মাথা, পকেট থেকে বার করে তার হিসেব লেখার খাতা। লিখ্ল তাতে— “শোন্ রে জগাই, ভীষণ লড়াই হলো, পাঁচ ব্যাটাকে খতম করে জগাইদাদা মোলো।”ছায়াবাজি আবোল তাবোল,আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা— ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা! ছায়া ধরার ব্যবসা করি তাও জানো না বুঝি? রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেকরকম পুঁজি! শিশির ভেজা সদ্য ছায়া, সকাল বেলায় তাজা, গ্রীষ্মকালে শুকনো ছায়া ভীষণ রোদে ভাজা। চিলগুলো যায় দুপুরবেলায় আকাশ পথে ঘুরে, ফাঁদ ফেলে তার ছায়ার উপর খাঁচায় রাখি পুরে। কাগের ছায়া বগের ছায়া দেখছি কত ঘেঁটে— হাল্কা মেঘের পানসে ছায়া তাও দেখেছি চেটে। কেউ জানে না এ-সব কথা কেউ বোঝে না কিছু, কেউ ঘোরে না আমার মতো ছায়ার পিছুপিছু। তোমরা ভাব গাছের ছায়া অমনি লুটায় ভূঁয়ে, অমনি শুধু ঘুমায় বুঝি শান্ত মতন শুয়ে; আসল ব্যাপার জানবে যদি আমার কথা শোনো, বলছি যা তা সত্যি কথা, সন্দেহ নাই কোনো। কেউ যবে তার রয় না কাছে, দেখতে নাহি পায়, গাছের ছায়া ছট্ফটিয়ে এদিক-ওদিক চায়। সেই সময়ে গুড়গুড়িয়ে পিছন হতে এসে ধামায় চেপে ধপাস্ করে ধরবে তারে ঠেসে। পাতলা ছায়া, ফোক্লা ছায়া, ছায়া গভীর কালো— গাছের চেয়ে গাছের ছায়া সব রকমেই ভালো। গাছ গাছালি শেকড় বাকড় মিথ্যে সবাই গেলে, বাপ্ রে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে। নিমের ছায়া ঝিঙের ছায়া তিক্ত ছায়ার পাক, যেই খাবে ভাই অঘোর ঘুমে ডাকবে তাহার নাক। চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পারো, শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো। আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়, ল্যাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নাই তায়। আষাঢ় মাসের বাদলা দিনে বাঁচতে যদি চাও, তেঁতুল তলার তপ্ত ছায়া হপ্তা তিনেক খাও। মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া ‘ব্লটিং’ দিয়ে শুষে, ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখছি ঘরে পুষে! পাক্কা নতুন টাট্কা ওষুধ এক্কেবারে দিশি— দাম করেছি শস্তা বড়, চোদ্দ আনা শিশি।কুম্ড়োপটাশ আবোল তাবোল,(যদি) কুম্ড়োপটাশ নাচে— খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে; চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে; চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে! (যদি) কুম্ড়োপটাশ কাঁদে— খবরদার! খবরদার! বসবে না কেউ ছাদে; উপুড় হয়ে মাচায় শুয়ে লেপ কম্বল কাঁধে; বেহাগ সুরে গাইবে খালি ‘রাধে কৃষ্ণ রাধে’! (যদি) কুম্ড়োপটাশ হাসে— থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে; ঝাপ্সা গলায় ফার্সি কবে নিশ্বাসে ফিস্ফাসে; তিনটি বেলায় উপোশ করে থাকবে শুয়ে ঘাসে! (যদি) কুম্ড়োপটাশ ছোটে— সবাই যেন তড়বড়িয়ে জানলা বেয়ে ওঠে; হুঁকোর জলে আলতা গুলে লাগায় গালে ঠোঁটে; ভুলেও যেন আকাশ পানে তাকায় না কেউ মোটে! (যদি) কুম্ড়োপটাশ ডাকে— সবাই যেন শাম্লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে; ছেঁচকি শাকের ঘন্ট বেটে মাথায় মলম মাখে; শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে! তুচ্ছ ভেবে এ-সব কথা করছে যারা হেলা, কুম্ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা। দেখবে তখন কোন কথাটি কেমন করে ফলে, আমায় তখন দোষ দিও না, আগেই রাখি বলে।সাবধান আবোল তাবোলআরে আরে, ওকি কর প্যালারাম বিশ্বাস? ফোঁস্ফোঁস্ অত জোরে ফেলো নাকো নিশ্বাস! জানো না কি সে-বছর ও-পাড়ার ভুতোনাথ, নিশ্বাস নিতে গিয়ে হয়েছিল কুপোকাৎ? হাঁপ ছাড় হ্যাঁস্ফ্যাঁস্ ওরকম হাঁ করে— মুখে যদি ঢুকে বসে পোকা মাছি মাকড়ে? বিপিনের খুড়ো হয় বুড়ো সেই হল’ রায়, মাছি খেয়ে পাঁচমাস ভুগেছিল কলেরায়। তাই বলি— সাবধান! ক’রো নাকো ধুপ্ধাপ্, টিপি টিপি পায় পায় চলে যাও চুপ্চাপ্। চেয়ো নাকি আগে পিছে, যেয়ো নাকো ডাইনে সাবধানে বাঁচে লোকে— এই লেখে আইনে। পড়েছ তো কথামালা? কে যেন সে কি করে পথে যেতে পড়ে গেল পাতকোর ভিতরে? ভালো কথা— আর যেন সকালে কি দুপুরে, নেয়ো নাকো কোনোদিন ঘোষেদের পুকুরে; এরকম মোটা দেহে কি যে হবে কোন্ দিন, কথাটাকে ভেবে দেখ কিরকম সঙ্গিন! চটো কেন? হয় নয় কে বা জানে পষ্ট, যদি কিছু হয়ে পড়ে পাবে শেষে কষ্ট। মিছিমিছি ঘ্যান্ঘ্যান্ কেন কর তক্ক? শিখেছ জ্যাঠামো খালি, ইঁচড়েতে পক্ব, মানবে না কোনো কথা চলা ফেরা আহারে, একদিন টের পাবে ঠেলা কয় কাহারে। রমেশের মেজমামা সেও ছিল সেয়না, যত বলি ভালো কথা কানে কিছু নেয় না— শেষকালে একদিন চান্নির বাজারে পড়ে গেল গাড়ি চাপা রাস্তার মাঝারে!বাবুরাম সাপুড়ে আবোল তাবোলবাবুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস্ বাপুরে? আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা— যে সাপের চোখ্ নেই, শিং নেই, নোখ্ নেই, ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না, করে নাকো ফোঁস্ফাঁস্, মারে নাকো ঢুঁশ্ঢাঁশ, নেই কোনো উৎপাত, খায় শুধু দুধ ভাত— সেই সাপ জ্যান্ত গোটা দুই আন্ তো! তেড়ে মেরে ডাণ্ডা ক’রে দিই ঠাণ্ডা।হাতুড়ে আবোল তাবোলএকবার দেখে যাও ডাক্তারি কেরামৎ— কাটা ছেঁড়া ভাঙা চেরা চট্পট্ মেরামৎ। কয়েছেন গুরু মোর, “শোন শোন বৎস, কাগজের রোগী কেটে আগে কর মক্স।” উৎসাহে কিনা হয় কিনা হয় চেষ্টায়? অভ্যাসে চট্পট্ হাত পাকে শেষটায়। খেটে খুটে জল হল শরীরের রক্ত— শিখে দেখি বিদ্যেটা নয় কিছু শক্ত। কাটা ছেঁড়া ঠুক্ঠাক্, কত দেখ যন্ত্র, ভেঙে চুরে জুড়ে দিই তারও জানি মন্ত্র। চোখ বুঝে চট্পট্ বড়-বড় মূর্তি, যত কাটি ঘ্যাঁস্ ঘ্যাঁস্ তত বাড়ে ফূর্তি। ঠ্যাং-কাটা গলা-কাটা কত কাটা হস্ত, শিরিষের আঠা দিয়ে জুড়ে দেয় চোস্ত। এইবারে বলি তাই রোগী চাই জ্যান্ত— ওরে ভোলা, গোটাছয় রোগী ধরে আন্ তো! গেঁটে বাতে ভুগে মরে ও পাড়ার নন্দী, কিছুতেই সারাবে না এই তার ফন্দি— একদিন এনে তারে এইখানে ভুলিয়ে, গেঁটেবাত ঘেঁটে-ঘুঁটে সব দেব ঘুলিয়ে। কার কানে কট্কট্ কার কনে সর্দি, এস, এস, ভয় কিসে? আমি আছি বদ্যি। শুয়ে কেরে? ঠ্যাং-ভাঙা? ধ’রে আন এখেনে, স্ক্রুপ দিয়ে এঁটে দেব কিরকম দেখে নে। গালফোলা কাঁদ কেন? দাঁতে ভুঝি বেদনা? এস এস ঠুকে দেই— আর মিছে কেঁদো না এই পাশে গোটা দুই, ওই পাশে তিনটে— দাঁত গুলো টেনে দেখি কোথা গেলো চিমটে? ছেলে হও, বুড়ো হও, অন্ধ কি পঙ্গু, মোর কাছে ভেদ নাই কলেরা কি ডেঙ্গু— কালাজ্বর, পালাজ্বর, পুরানো কি টাট্কা, হাতুড়ির এক ঘায়ে একেবারে আট্কা!চোর ধরা আবোল তাবোলআরে ছি ছি! রাম রাম! ব’লো না হে ব’লো না— চল্ছে যা জুয়াচুরি, নাহি তার তুলনা। যেই আমি দেই ঘুম টিফিনের আগেতে, ভ্য়ানক ক’মে যায় খাবারের ভাগেতে! রোজ দেখি খেয়ে গেছে, জানি নেকো কারা সে— কালকে যা হ’য়ে গেল ডাকাতির বাড়া সে! পাঁচখানা কাট্লেট্, লুচি তিন গণ্ডা, গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা, আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঙ্নি— ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতখানা শূন্যি! তাই আজ ক্ষেপে গেছি— কত আর পার্ব? এতদিন স’য়ে স’য়ে এইবার মার্ব। খাড়া আছি সারাদিন হুঁশিয়ার পাহারা, দেখে নেব রোজ রোজ খেয়ে যায় কাহারা। রামু হও, দামু হও, ওপাড়ার ঘোষ বোস্— যেই হও এইবারে থেমে যাবে ফোঁস্ফোঁস্। খাট্বে না জারিজুরি আঁট্বে না মার্প্যাঁচ্, যারে পাব ঘাড়ে ধ’রে কেটে দেব ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ। এই দেখ ঢাল নিয়ে খাড়া আছি আড়ালে, এইবারে টের পাবে মুণ্ডুটা বাড়ালে। রোজ বলি ‘সাবধান!’ কানে তবু যায় না? ঠেলাখানা বুঝ্বি তো এইবারে আয় না।অবাক কাণ্ড আবোল তাবোলশুন্ছ দাদা! ওই যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে, সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে? শুন্ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে? চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে? চল্তে গেলে ঠ্যাং নাকি তার ভূঁয়ের পরে ঠেকে? কান দিয়ে সব শোনে নাকি? চোখ দিয়ে সব দেখে? শোয় নাকি সে মুণ্ডুটাকে শিয়র পানে দিয়ে? হয় কি না হয় সত্যি মিথ্যা চল্ না দেখি গিয়ে!ভাল রে ভাল আবোল তাবোলদাদা গো! দেখ্ছি ভেবে অনেক দূর— এই দুনিয়ার সকল ভালো, আসল ভালো নকল ভালো, শস্তা ভালো দামীও ভালো, তুমিও ভালো আমিও ভালো, হেথায় গানের ছন্দ ভালো, হেথায় ফুলের গন্ধ ভালো, মেঘ-মাখানো আকাশ ভালো, ঢেউ-জাগানো বাতাস ভালো, গ্রীষ্ম ভালো বর্ষা ভালো, ময়লা ভালো ফর্সা ভালো, পোলাও ভালো কোর্মা ভালো, মাছ-পটোলের দোল্মা ভালো, কাঁচাও ভালো পাকাও ভালো, সোজাও ভালো বাঁকাও ভালো, কাঁসিও ভালো ঢাকও ভালো, টিকিও ভালো টাকও ভালো, ঠেলার গাড়ি ঠেল্তে ভালো, খাস্তা লুচি বেল্তে ভালো, গিট্কিরি গান শুনতে ভালো, শিমূল তুলো ধুন্তে ভালো, ঠাণ্ডা জলে নাইতে ভালো, কিন্তু সবার চাইতে ভালো— পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়।কিম্ভূত আবোল তাবোলবিদঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভূত, সারাদিন ধ’রে তার শুনি শুধু খুঁতখুঁত। মাঠপারে ঘাটপারে কেঁদে মরে খালি সে, ঘ্যান্ ঘ্যান্ আব্দারে ঘন ঘন নালিশে। এটা চাই সেটা চাই কত তার বায়না— কি যে চায় তাও ছাই বোঝা কিছু যায় না। কোকিলের মতো তার কণ্ঠেতে সুর চাই, গলা শুনে আপনার বলে, ‘উঁহু, দূর ছাই!’ আকাশেতে উড়ে যেতে পাখিদের মানা নেই, তাই দেখে মরে কেঁদে— তার কেন ডানা নেই! হাতিটার কী বাহার দাঁতে আর শুণ্ডে— ওরকম জুড়ে তার দিতে হবে মুণ্ডে! ক্যাঙ্গারুর লাফ দেখে ভারি তার হিংসে— ঠ্যাং চাই আজ থেকে ঢ্যাংঢেঙে চিম্সে! সিংহের কেশরের মতো তার তেজ কই? পিছে খাসা গোসাপের খাঁজকাটা লেজ কই? একলা সে সব হ’লে মেটে তার প্যাখ্না; যারে পায় তারে বলে, ‘মোর দশা দেখ্ না!’ কেঁদে কেঁদে শেষটায়— আষাঢ়ের বাইশে— হ’ল বিনা চেষ্টায় চেয়েছে যা তাই সে। ভুলে গিয়ে কাঁদাকাটি আহ্লাদে আবেশে চুপি চুপি একলাটি ব’সে ব’সে ভাবে সে— লাফ দিয়ে হুশ্ করে হাতি কভু নাচে কি? কলাগাছ খেলে পরে ক্যাঙ্গারুটা বাঁচে কি? ভোঁতামুখে কুহুডাক শুনে লোকে কবে কী? এই দেহে শুঁড়ো নাক খাপছাড়া হবে কি? ‘বুড়ো হাতি ওড়ে’ ব’লে কেউ যদি গালি দেয়? কান টেনে ল্যাজ্ ম’লে ‘দুয়ো’ বলে তালি দেয়? কেউ যদি তেড়েমেড়ে বলে তার সামনেই— ‘কোথাকার তুই কেরে, নাম নেই ধাম নেই?’ জবাব কি দেবে ছাই, আছে কিছু বল্বার? কাঁচুমাচু ব’সে তাই, মনে শুধু তোল্পাড়— ‘নই ঘোড়া, নই হাতি, নই সাপ বিচ্ছু, মৌমাছি প্রজাপতি নই আমি কিচ্ছু। মাছ ব্যাঙ গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই, নই জুতা নই ছাতা, আমি তবে কেউ নই!’নেড়া বেলতলায় যায় ক’বার? আবোল তাবোলরোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা তার উপরে বসল রাজা— ঠোঙাভরা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না। গায়ে আঁটা গরম জামা পুড়ে পিঠ হচ্ছে ঝামা; রাজা বলে, “বৃষ্টি নামা— নইলে কিচ্ছু মিলছে না।” থাকে সারা দুপুর ধ’রে ব’সে ব’সে চুপ্টি ক’রে, হাঁড়িপানা মুখটি ক’রে আঁক্ড়ে ধ’রে শ্লেটটুকু; ঘেমে ঘেমে উঠছে ভিজে ভ্যাবাচ্যাকা একলা নিজে, হিজিবিজি লিখছে কি যে বুঝছে না কেউ একটুকু। ঝাঁঝা রোদ আকাশ জুড়ে মাথাটার ঝাঁঝ্রা ফুঁড়ে, মগজেতে নাচছে ঘুরে রক্তগুলো ঝনর্ ঝন্; ঠাঠা’-পড়া দুপুর দিনে, রাজা বলে আর বাঁচি নে, ছুটে আন্ বরফ কিনে— কচ্ছে কেমন গা ছন্ছন্।” সবে বলে। “হায় কি হল! রাজা বুঝি ভেবেই মোলো! ওগো রাজা মুখটি খোল— কও না ইহার কারণ কি? রাঙামুখ পানসে যেন তেলে ভাজা আম্সি হেন, রাজা এত ঘামছে কেন— শুনতে মোদের বারণ কি? রাজা বলে, “কেইবা শোনে যে কথাটা ঘুরছে মনে, মগজের নানান্ কোণে— আনছি টেনে বাইরে তায়, সে কথাটা বলছি শোন, যতই ভাব যতই গোণ, নাহি তার জবাব কোনো কূলকিনারা নাই রে হায়! লেখা আছে পুঁথির পাতে, ‘নেড়া যায় বেলতলাতে,’ নাহি কোনো সন্দ তাতে— কিন্তু প্রশ্ন ‘কবার যায়?’ এ কথাটা এদ্দিনেও পারে নিকো বুঝতে কেও, লেখে নিকো পুস্তকেও, দিচ্ছে না কেউ জবাব তায়। লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে? ভেবে তাই পাই নে দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?” এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা ঢিপ্ ক’রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দু’পায় তাঁর। হেসে বলে, “আজ্ঞে সে কি? এতে আর গোল হবে কি? নেড়াকে তো নিত্যি দেখি আপন চোখে পরিষ্কার— আমাদেরি বেলতলা সে নেড়া সেথা খেলতে আসে হরে দরে হয়তো মাসে নিদেন পক্ষে পঁচিশ বার।”বুঝিয়ে বলা আবোল তাবোলও শ্যামাদাস! আয় তো দেখি, বোস তো দেখি এখেনে, সেই কথাটা বুঝিয়ে দেব পাঁচ মিনিটে, দেখে নে। জ্বর হয়েছে? মিথ্যে কথা! ও-সব তোদের চালাকি— এই যে বাবা চেচাঁচ্ছিলি, শুনতে পাই নি? কালা কি? মামার ব্যামো? বদ্যি ডাকবি? ডাকিস নাহয় বিকেলে; না হয় আমি বাৎলে দেব বাঁচবে মামা কি খেলে! আজকে তোকে সেই কথাটা বোঝাবই বোঝাব— না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাব। কোন কথাটা? তাও ভুলেছিস্? ছেড়ে দিছিস্ হাওয়াতে? কি বল্ছিলেম পরশু রাতে বিষ্টু বোসের দাওয়াতে? ভুলিস নি তো বেশ করেছিস্, আবার শুনলে ক্ষেতি কি? বড় যে তুই পালিয়ে বেড়াস্, মাড়াস্ নে যে এদিক্ই! বলছি দাঁড়া, ব্যস্ত কেন? বোস্ তাহলে নিচুতেই— আজকালের এই ছোক্রাগুলোর তর্ সয় না কিছুতেই। আবার দেখ! বসলি কেন? বইগুলো আন্ নামিয়ে— তুই থাক্তে মুটের বোঝা বইতে যাব আমি এ? সাবধানে আন্, ধরছি দাঁড়া— সেই আমাকেই ঘামালি, এই খেয়েছে কোন আক্কেলে শব্দকোষটা নামালি? ঢের হয়েছে! আয় দেখি তুই বোস্ তো দেখি এদিকে— ওরে গোপাল গোটাকয়েক পান দিতে বল খেঁদিকে।— বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সুক্ষ্ম হতে স্থুলেতে, অর্থাৎ কিনা লাগছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে— গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি ক’রে, রস জমে ওই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে। অর্থাৎ কিনা, এই মনে কর্ রোদ পড়েছে ঘাসেতে, এই মনে কর্, চাঁদের আলো পড়লো তারই পাশেতে— আবার দেখ! এরই মধ্যে হাই তোলবার মানে কি? আকাশপানে তাকাস্ খালি, যাচ্ছে কথা কানে কি? কি বল্লি তুই? এ-সব শুধু আবোল তাবোল বকুনি? বুঝতে হলে মগজ লাগে, বলেছিলাম তখনি। মগজভরা গোবর তোদের হচ্ছে ঘুঁটে শুকিয়ে, যায় কি দেওয়া কোনো কথা তার ভেতরে ঢুকিয়ে?— ও শ্যামাদাস! উঠলি কেন? কেবল যে চাস্ পালাতে! না শুনবি তো মিথ্যে সবাই আসিস কেন জ্বালাতে? তত্বকথা যায় না কানে যতই মরি চেঁচিয়ে— ইচ্ছে করে ডান্পিটেদের কান ম’লে দি পেঁচিয়ে।শব্দকল্পদ্রুম আবোল তাবোলঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খট্কা— ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্কা! শাঁই শাঁই পন্পন্, ভয়ে কান্ বন্ধ— ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ? হুড়মুড় ধুপ্ধাপ্— ওকি শুনি ভাই রে! দেখ্ছ না হিম পড়ে— যেও নাকো বাইরে। চুপ চুপ ঐ শোন্! ঝুপ্ ঝাপ্ ঝ-পাস! চাঁদ বুঝি ডুবে গেল?— গব্ গব্ গ-বাস! খ্যাঁশ্ খ্যাঁশ্ ঘ্যাঁচ্ ঘ্যাঁচ্, রাত কাটে ওই রে! দুড় দাড়্ চুরমার— ঘুম ভাঙে কই রে! ঘর্ঘর্ ভন্ ভন্ ঘোরে কত চিন্তা! কত মন নাচে শোন্— ধেই ধেই ধিন্তা! ঠুং ঠাং ঢং ঢং, কত ব্যথা বাজে রে— ফট্ ফট্ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে! হৈ হৈ মার্ মার্ ‘বাপ্ বাপ্’ চিৎকার— মালকোঁচা মারে বুঝি? সরে পড়্ এইবার।বুড়ির বাড়ি আবোল তাবোলগালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি, ঝুরঝুরে প’ড়ো ঘরে থুর্থুরে বুড়ি। কাঁথাভরা ঝুলকালি, মাথাভরা ধুলো, মিট্মিটে ঘোলা চোখ, পিঠখানা কুলো। কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর— আঠা দিয়ে সেঁটে, সুতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে। ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে, খক্ খক্ কাশি দিলে ঠক্ ঠক্ নড়ে। ডাকে যদি ফিরিওয়ালা, হাঁকে যদি গাড়ি, খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে যদি বাড়ি। বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত, ঝাঁট দিলে ঝ’রে পড়ে কাঠকুটো যত। ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদ্লায় ভিজে, একা বুড়ি কাঠি গুঁজে ঠেকা দেয় নিজে। মেরামত দিনরাত কেরামত ভারি, থুর্থুরে বুড়ি তার ঝুর্ঝুরে বাড়ি॥বোম্বাগড়ের রাজা আবোল তাবোলকেউ কি জান সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা— ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা? রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা? পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা? কেন সেথায় সর্দি হ’লে ডিগ্বাজি খায় লোকে? জোছনা রাতে সবাই কেন আলতা মাখায় চোখে? ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে? টাকের’পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে! রাত্রে কেন ট্যাঁক্ঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে ঘিয়ে? কেন রাজার বিছ্না পাতে শিরিষ কাগজ দিয়ে? সভায় কেন চেঁচায় রাজা ‘হুক্কা হুয়া’ ব’লে? মন্ত্রী কেন কল্সী বাজায় ব’সে রাজার কোলে? সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি? কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি? রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা প’রে? এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পার মোরে?একুশে আইন আবোল তাবোলশিব ঠাকুরের আপন দেশে, আইন কানুন সর্বনেশে! কেউ যদি যায় পিছ্লে প’ড়ে প্যায়দা এসে পাক্ড়ে ধরে, কাজির কাছে হয় বিচার— একুশ টাকা দণ্ড তার॥ সেথায় সন্ধ্যা ছ’টার আগে, হাঁচতে হ’লে টিকিট লাগে, হাঁচ্লে পরে বিন্টিকিটে— দম্দমাদম্ লাগায় পিঠে, কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে— একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে॥ কারুর যদি দাঁতটি নড়ে, চারটি টাকা মাশুল ধরে, কারুর যদি গোঁফ গজায়, একশো আনা ট্যাক্স চায়— খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়, সেলাম ঠোকায় একুশ বার॥ চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়, এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়, রাজার কাছে খবর ছোটে, পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে, দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায় একুশ হাতা জল গেলায়॥ যে-সব লোকে পদ্য লেখে, তাদের ধ’রে খাঁচায় রেখে, কানের কাছে নানান্ সুরে, নামতা শোনায় একশো উড়ে, সামনে রেখে মুদীর খাতা— হিসেব কষায় একুশ পাতা॥ হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে, নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে, অম্নি তেড়ে মাথায় ঘষে, গোবর গুলে বেলের কষে, একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে একুশ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে॥হুঁকো মুখো হ্যাংলা আবোল তাবোলহুঁকো মুখো হ্যাংলা বাড়ী তার বাংলা মুখে তার হাসি নাই দেখেছ? নাই তার মানে কি? কেউ তাহা জানে কি? কেউ কভু তার কাছে থেকেছ? শ্যামাদাস মামা তার আফিঙের থানাদার, আর তার কেউ নেই এ ছাড়া- তাই বুঝি একা সে মুখখানা ফ্যাকাশে, ব’সে আছে কাঁদ কাঁদ বেচারা? থপ্ থপ্ পায়ে সে নাচত যে আয়েসে, গলা ভরা ছিল তার ফুর্তি, গাইতো সে সারাদিন ‘সারে গামা টিম্ টিম্’ আহ্লাদে গদ-গদ মূর্তি। এই তো সে দুপুরে বসে ওই উপরে খাচ্ছিল কাঁচকলা চটকে- এর মাঝে হল কি? মামা তার মোলো কি? অথবা কি ঠ্যাং গেল মটকে? হুঁকোমুখো হেঁকে কয়, ‘আরে দূর, তা তো নয়, দেখছ না কি রকম চিন্তা? মাছি মারা ফন্দি এ যত ভাবি মন দিয়ে- ভেবে ভেবে কেটে যায় দিনটা। বসে যদি ডাইনে, লেখে মোর আইনে- এই ল্যাজে মাছি মারি ত্রস্ত; বামে যদি বসে তাও, নহি আমি পিছ্পাও, এই ল্যাজে আছে তার অস্ত্র। যদি দেখি কোনো পাজি বসে ঠিক মাঝামাঝি কি যে করি ভেবে নাহি পাইরে- ভেবে দেখ এ কি দায় কোন্ ল্যাজে মারি তায়, দুটি বই ল্যাজ মোর নাই রে!’দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম আবোল তাবোলছুটছে মোটর ঘটর ঘটর ছুটছে গাড়ি জুড়ি; ছুটছে লোকে নানান্ ঝোঁকে করছে হুড়িহুড়ি; ছুটছে কত ক্ষ্যাপার মতো পড়ছে কত চাপা— সাহেব মেমে থম্কে থেমে বলছে ‘মামা! পাপা!’ আমরা তবু তবলা ঠুকে গাচ্ছি কেমন তেড়ে, “দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!” বর্ষাকালের বৃষ্টিবাদল রাস্তা জুড়ে কাদা, ঠাণ্ডা রাতে সর্দিবাতে মরবি কেন দাদা? হোক্ না সকাল হোক্ না বিকাল হোক্ না দুপুর বেলা, থাক্ না তোমার আপিস যাওয়া থাক্ না কাজের ঠেলা— এই দেখ না চাঁদ্নি রাতের গান এনেছি কেড়ে, “দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!” মুখ্যু যারা হচ্ছে সারা পড়ছে ব’সে একা, কেউ-বা দেখ কাঁচুর মাচুর কেউ বা ভ্যাবাচ্যাকা; কেউ-বা ভেবে হদ্দ হল, মুখটি যেন কালি; কেউ-বা ব’সে বোকার মতো মুণ্ডু নাড়ে খালি। তার চেয়ে ভাই ভাবনা ভুলে গাও না গলা ছেড়ে “দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!” বেজার হয়ে যে যার মতো করছ সময় নষ্ট, হাঁটছ কত খাটছ কত পাচ্ছ কত কষ্ট! আসল কথা বুঝছ না যে, করছ না যে চিন্তা, শুনছ না যে গানের মাঝে তবলা বাজে ধিন্তা? পাল্লা ধরে গায়ের জোরে গিটকিরি দাও ঝেড়ে, “দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!”নারদ-নারদ আবোল তাবোল"হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল সাদাকে বল্ছিলি লাল? (আর) সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে নাক ডেকেছিস বিশ্রী সুরে? (আর) তোদের পোষা বেড়ালগুলো শুনছি নাকি বেজায় হুলো? (আর) এই যে শুনি তোদের বাড়ি কেউ নাকি রাখে না দাড়ি? ক্যান্ রে ব্যাটা ইস্টুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে কর্ব ঢিট্!" চোপরাও তুম্ স্পিক্টি নট্, মার্ব রগে পটাপট্— ফের যদি ট্যারাবি চোখ কিম্বা আবার কর্বি রোখ, কিম্বা যদি অম্নি করে মিথ্যেমিথ্যি চ্যাঁচাস জোরে— আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি—জানিস আমি স্যান্ডো করি? ফের লাফাচ্ছিস্? অল্রাইট্ কামেন্ ফাইট্! কামেন্ ফাইট্!" "ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখ নি, টেরটা পাবে আজ এখনি। আজকে যদি থাকত মামা পিটিয়ে তোমায় কর্ত ঝামা। আরে! আরে! মার্বি নাকি? দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি! হাঁহাঁহাঁহাঁ! রাগ ক’রো না, কর্তে চাও কি তাই বল না?" "হ্যাঁ হ্যাঁ তাতো সত্যি বটেই আমি তো চটি নি মোটেই! মিথ্যে কেনো লড়তে যাবি? ভেরি-ভেরি সরি মসলা খাবি? ’শেক্হ্যান্ড’ আর’দাদা’ বল সব শোধ বোধ ঘরে চল। ডোন্ট পরোয়া অল্ রাইট্ হাউ ডুয়ুডু গুড্ নাইট্।"কি মুস্কিল আবোল তাবোলসব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত, সরকারি সব আফিসখানার কোন্ সাহেবের কদর কত। কেমন ক’রে চাট্নি বানায়, কেমন ক’রে পোলাও করে, হরেক্ রকম মুষ্টিযোগের বিধান লিখছে ফলাও ক’রে। সাবান কালি দাঁতের মাজন বানাবার সব কায়দা কেতা, পূজা পার্বণ তিথির হিসাব শ্রাদ্ধবিধি লিখছে হেথা। সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছি নেকো লেখা কোথায়— পাগলা ষাঁড়ে কর্লে তাড়া কেমন ক’রে ঠেকাব তায়!ভুতুড়ে খেলা আবোল তাবোলপরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে, পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছ্নাতে। কচ্ছে খেলা মায়ের কোলে হাত-পা নেড়ে উল্লাসে, আহ্লাদেতে ধুপধুপিয়ে কচ্ছে কেমন হল্লা সে। শুনতে পেলাম ভুতের মায়ের মুচকি হাসি কট্কটে— দেখছে নেড়ে ঝুন্টি ধ’রে বাচ্চা কেমন চট্পটে। উঠছে তাদের হাসির হানা কাষ্ঠ সুরে ডাক ছেড়ে, খ্যাঁশ্ খ্যাঁশানি শব্দে যেন করাত দিয়ে কাঠ চেরে! যেমন খুশি মারছে ঘুঁষি, দিচ্ছে কষে কানমলা, আদর ক’রে আছাড় মেরে শূন্যে ঝোলে চ্যাং দোলা। বলছে আবার, “আয় রে আমার নোংরামুখো সুঁটকো রে, দেখ না ফিরে প্যাখ্না ধরে হুতোম-হাসি মুখ করে! ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোঁত্কা রে, অন্ধবনের গন্ধ-গোকুল, ওরে আমার হোঁত্কা রে! ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্ঠি মাসের বিষ্টি রে, ওরে আমার হামান-ছেঁড়া জষ্ঠিমধুর মিষ্টি রে। ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার, ওরে আমার জোছ্না হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার। ওরে আমার গোবরাগণেশ ময়দাঠাসা নাদুস্ রে, ছিঁচকাঁদুনে ফোক্লা মানিক, ফের যদি তুই কাঁদিস রে—” এই না বলে যেই মেরেছে কাদার চাপটি ফট্ ক’রে, কোথায়-বা কি, ভুতের ফাঁকি— মিলিয়ে গেল চট্ ক’রে!ডানপিটে আবোল তাবোলবাপ্ রে কি ডানপিটে ছেলে!— কোন্ দিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে। একটা সে ভূত সেজে আঠা মেখে মুখে, ঠাঁই ঠাঁই শিশি ভাঙে শ্লেট দিয়ে ঠুকে! অন্যটা হামা দিয়ে আলমারি চড়ে, খাট থেকে রাগ ক’রে দুম্দাম্ পড়ে! বাপ্ রে কি ডানপিটে ছেলে!— শিলনোড়া খেতে চায় দুধভাত ফেলে! একটার দাঁত নেই, জিভ দিয়ে ঘ’ষে, এক মনে মোমবাতি দেশলাই চোষে! আরজন ঘরময় নীল কালি গুলে, কপ্কপ্ মাছি ধ’রে মুখে দেয় তুলে! বাপ্ রে কি ডানপিটে ছেলে!— খুন হ’ত টম্ চাচা ওই রুটি খেলে! সন্দেহে শুঁকে বুড়ো মুখে নাহি তোলে, রেগে তাই দুই ভাই ফোঁস্ ফোঁস্ ফোলে! নেড়াচুল খাড়া হয়ে রাঙা হয় রাগে, বাপ্ বাপ্ ব’লে চাচা লাফ দিয়ে ভাগে।রামগরুড়ের ছানা আবোল তাবোলরামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা, হাসির কথা শুনলে বলে, “হাসব না-না, না-না!” সদাই মরে ত্রাসে— ওই বুঝি কেউ হাসে! এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে তাকায় আশে পাশে। ঘুম নাহি তার চোখে আপনি ব’কে ব’কে আপনারে কয়, “হাসিস যদি মারব কিন্তু তোকে!” যায় না বনের কাছে, কিম্বা গাছে গাছে, দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে হাসিয়ে ফেলে পাছে! সোয়াস্তি নেই মনে— মেঘের কোণে কোণে হাসির বাষ্প উঠছে ফেঁপে কান পেতে তাই শোনে! ঝোপের ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে জোনাক জ্বলে আলোর তালে হাসির ঠারে ঠারে। হাসতে হাসতে যারা হচ্ছে কেবল সারা, রামগরুড়ের লাগছে ব্যথা বুঝছে না কি তারা? রামগরুড়ের বাসা ধমক দিয়ে ঠাসা, হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়, নিষেধ সেথায় হাসা।আহ্লাদী আবোল তাবোলহাসছি মোরা হাসছি দেখ, হাসছি মোরা আহ্লাদী, তিনজনেতে জট্লা ক’রে ফোক্লা হাসির পালা দি। হাসতে হাসতে আসছে দাদা আসছি আমি আসছে ভাই, হাসছি কেন কেউ জানে না, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই। ভাবছি মনে, হাসছি কেন? থাকব হাসি ত্যাগ ক’রে, ভাবতে গিয়ে ফিকফিকিয়ে ফেলছি হেসে ফ্যাক ক’রে। পাচ্ছে হাসি চাইতে গিয়ে, পাচ্ছে হাসি চোখ বুজে, পাচ্ছে হাসি চিমটি কেটে নাকের ভিতর নোখ গুঁজে। হাসছি দেখে চাঁদের কলা জোলার মাকু জেলের দাঁড় নৌকা ফানুস পিঁপড়ে মানুষ রেলের গাড়ি তেলের ভাঁড়। পড়তে গিয়ে ফেলছি হেসে ‘ক খ গ’ আর শ্লেট দেখে— উঠছে হাসি ভস্ভসিয়ে সোডার মতন পেট থেকে।হাত গণনা আবোল তাবোলও পাড়ার নন্দ গোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো, স্বভাবেতে সরল সোজা অমায়িক শান্ত বুড়ো। ছিল না তার অসুখবিসুখ, ছিল যে সে মনের সুখে, দেখা যেত সদাই তারে হুঁকোহাতে হাস্যমুখে। হঠাৎ কি তার খেয়াল হল, চল্ল সে তার হাত দেখাতে— ফিরে এল শুকনো সরু, ঠকাঠক্ কাঁপছে দাঁতে! শুধালে সে কয় না কথা, আকাশেতে রয় সে চেয়ে, মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে, পড়ে জল চক্ষু বেয়ে। শুনে লোক দৌড়ে এল, ছুটে এলেন বদ্যিমশাই, সবাই বলে, ‘কাঁদছ কেন? কি হয়েছে নন্দগোঁসাই?’ খুড়ো বলে, ‘বলব কি আর, হাতে আমার পষ্ট লেখা আমার ঘাড়ে আছেন শনি, ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা। এতদিন যায় নি জানা ফিরছি কত গ্রহের ফেরে— হঠাৎ আমার প্রাণটা গেলে তখন আমায় রাখবে কে রে? ষাটটা বছর পার হয়েছি বাপদাদাদের পুণ্যফলে— ওরে তোদের নন্দখুড়ো এবার বুঝি পটোল তোলে। কবে যে কি ঘটবে বিপদ কিছু হায় যায় না বলা—’ এই ব’লে সে উঠল কেঁদে ছেড়ে ভীষণ উচ্চ গলা। দেখে এলাম আজ সকালে গিয়ে ওদের পাড়ার মুখো, বুড়ো আছে নেই কো হাসি, হাতে তার নেই কো হুঁকো।গন্ধ বিচার আবোল তাবোলসিংহাসনে বস্ল রাজা বাজল কাঁসর ঘণ্টা, ছট্ফটিযে উঠল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর মনটা। বল্লে রাজা, “মন্ত্রী তোমার জামায় কেন গন্ধ?” মন্ত্রী বলে, “এসেন্স দিছি— গন্ধ তো নয় মন্দ!” রাজা বলেন, “মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি,” বদ্যি বলে, “আমার নাকে বেজায় হল সর্দি।” রাজা হাঁকেন, “বোলাও তবে— রাম নারায়ণ পাত্র।” পাত্র বলে, “নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র— নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক গন্ধ কোথায় ঢুকবে?” রাজা বলেন, “কোটাল তবে এগিয়ে এস, শুঁকবে।” কোটাল বলে, “পান খেয়েছি মশলা তাহে কর্পূর, গন্ধে তারি মুণ্ড আমার এক্কেবারে ভরপুর।” রাজা বলেন, “আসুক তবে শের পালোয়ান ভীমসিং,” ভীম বলে “আজ কচ্ছে আমার সমস্ত গা ঝিম্ ঝিম্। রাত্রে আমার বোখার হল বলছি হুজুর ঠিক বাৎ,” ব’লেই শুল রাজসভাতে চক্ষু বুজে চিৎপাত। রাজার শালা চন্দ্রকেতু তারেই ধ’রে শেষটা, বল্ল রাজা, “তুমিই নাহয় কর না ভাই চেষ্টা।” চন্দ্র বলেন, “মারতে চাও তো ডাকাও নাকো জল্লাদ, গন্ধ শুঁকে মরতে হবে এ আবার কি আহ্লাদ?” ছিল হাজির বৃদ্ধ নাজির বয়সটি তার নব্বই, ভাবল মনে, ‘ভয় কেন আর, একদিন তো মরবই—’ সাহস ক’রে বল্লে বুড়ো, “মিথ্যে সবাই বকছিস, শুঁকতে পারি হুকুম পেলে এবং পেলে বক্শিশ্।” রাজা বলেন, “হাজার টাকা ইনাম পাবে সদ্য”, তাই না শুনে উৎসাহেতে উঠল বুড়ো মদ্দ। জামার পরে নাক ঠেকিয়ে— শুঁকল কত গন্ধ, রইল অটল দেখল লোকে বিস্ময়ে বাক্ বন্ধ। রাজ্যে হল জয় জয়কার বাজল কাঁসর ঢক্কা, বাপ রে কি তেজ বুড়োর হাড়ে পায় না সে যে অক্কা?কাঁদুনে আবোল তাবোলছিঁচ্কাঁদুনে মিচ্কে যারা শস্তা কেঁদে নাম কেনে, ঘ্যাঁঙায় শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর ঘ্যানঘ্যানে আর প্যানপ্যানে— কুঁকিয়ে কাঁদে ক্ষিদের সময়, ফুঁপিয়ে কাঁদে ধমকালে, কিম্বা হঠাৎ লাগলে ব্যথা, কিম্বা ভয়ে চম্কালে; অল্পে হাসে অল্পে কাঁদে, কান্না থামায় অল্পেতেই, মায়ের আদর দুধের বোতল কিম্বা দিদির গল্পেতেই— তরেই বলি মিথ্যে কাঁদন; আসল কান্না শুনবে কে? অবাক্ হবে থম্কে রবে সেই কাঁদনের গুণ দেখে! নন্দঘোষের পাশের বাড়ি বুথ্ সাহেবের বাচ্চাটার কান্নাখানা শুনলে বলি কান্না বটে সাচ্চা তার। কাঁদবে না সে যখন তখন, রাখবে কেবল রাগ পুষে, কাঁদবে যখন খেয়াল হবে খুন-কাঁদুনে রাক্ষুসে! নাইকো কারণ নাইকো বিচার মাঝরাতে কি ভোরবেলা, হঠাৎ শুনি অর্থবিহীন আকাশ-ফাটন জোর গলা। হাঁকড়ে ছোটে কান্না যেমন জোয়ার বেগে নদীর বান, বাপ-মা বসেন হতাশ হয়ে শব্দ শুনে বধির কান। বাস রে সে কি লোহার গলা? এক মিনিটও শান্তি নেই? কাঁদন ঝরে শ্রাবণ ধারে, ক্ষান্ত দেবার নামটি নেই! ঝুমঝুমি দাও, পুতুল নাচাও, মিষ্টি খাওয়াও একশোবার, বাতাস কর, চাপড়ে ধর, ফুটবে নাকো হাস্য তার। কান্নাভরে উল্টে পড়ে কান্না ঝরে নাক দিয়ে, গিল্তে চাহে দালানবাড়ি হাঁ’খানি তার হাঁক্ দিয়ে, ভূত-ভাগানো শব্দে লোকে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে— কান্না শুনে ধন্যি বলি বুথ সাহেবের বাচ্চারে।হুলোর গান আবোল তাবোলবিদ্ঘুটে রাত্তিরে ঘুট্ঘুটে ফাঁকা, গাছপালা মিশ্মিশে মখ্মলে ঢাকা, জট্বাঁধা ঝুল কালো বটগাছতলে, ধক্ধক্ জোনাকির চক্মকি জ্বলে, চুপচাপ চারিদিকে ঝোপঝাড়গুলো, আয় ভাই গান গাই আয় ভাই হুলো। গীত গাই কানে কানে চিৎকার ক’রে, কোন্ গানে মন ভেজে শোন্ বলি তোরে! পুবদিকে মাঝরাতে ছোপ্ দিয়ে রাঙা রাতকানা চাঁদ ওঠে আধখানা ভাঙা। চট্ ক’রে মনে পড়ে মট্কার কাছে মালপোয়া আধখানা কাল থেকে আছে। দুড়্ দুড়্ ছুটে যাই, দূর থেকে দেখি প্রাণপণে ঠোঁট চাটে কানকাটা নেকী! গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা, ধুক ক’রে নিভে গেল বুক ভরা আশা; মন বলে আর কেন সংসারে থাকি বিল্কুল্ সব দেখি ভেল্কির ফাঁকি। সব যেন বিচ্ছিরি, সব যেন খালি, গিন্নীর মুখ যেন চিম্নির কালি। মন-ভাঙা দুখ্ মোর কণ্ঠেতে পূরে গান গাই আয় ভাই প্রাণফাটা সুরে।ঠিকানা আবোল তাবোলআরে আরে জগমোহন— এস, এস, এস— বলতে পারো কোথায় থাকে আদ্যানাথের মেসো? আদ্যানাথের নাম শোননি? খগেন কে তো চেনো? শ্যাম বাগচি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো। শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন তার যে বাড়িওয়ালা, কি যেন নাম ভুলে গেছি, তারই মামার শালা। তারই পিসের খুড়তুতো ভাই আদ্যানাথের মেসো লক্ষ্মী দাদা ঠিকানা তার একটু জেনে এসো। ঠিকানা চাও? বলছি শোন আমড়া তলার মোড়ে, তিন মুখো তিন রাস্তা গেছে তারই একটা ধরে, চলবে সিধে নাক বরাবর ডানদিকে চোখ রেখে— চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে। দেখবে সেথায় ডাইনে বাঁয়ে পথ গিয়েছে কত, তারই মধ্যে ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধার মত। তার পরেতে হঠাত বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে, ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে। তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে— তারপর যাও যেথায় খুশি জ্বালিও নাকো মোরে!গল্প বলা আবোল তাবোল“এক যে রাজা”— “থাম্ না দাদা, রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা।” “তার যে মাতুল”— “মাতুল কি সে? সবাই জানে সে তার পিসে।” “তার ছিল এক ছাগল ছানা”— “ছাগলের কি গজায় ডানা?” “একদিন তার ছাতের’পরে”— “ছাত কোথা হে টিনের ঘরে?” “বাগানের এক উড়ে মালী”— “মালী নয়তো! মেহের আলি”— “মনের সাধে গাইছে বেহাগ,” “বেহাগ তো নয়! বসন্ত রাগ।” “থও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি”— “আচ্ছা বল, চুপ করেছি।” “এমন সময় বিছ্না ছেড়ে, হঠাৎ মামা আসল তেড়ে, ধর্ল সে তার ঝুঁটির গোড়া—” “কোথায় ঝুঁটি? টাক যে ভরা।” “হোক না টেকো তোর তাতে কি? লক্ষ্মীছাড়া মুখ্যু ঢেঁকি! ধর্ব ঠেসে টুঁটির’পরে, পিটব তোমার মুণ্ডু ধ’রে— কথার উপর কেবল কথা, এখন বাপু পালাও কোথা?”নোট বই আবোল তাবোলএই দেখ পেনসিল্ নোটবুক এ-হাতে, এই দেখ ভরা সব কিল্বিল্ লেখাতে। ভালো কথা শুনি যেই চট্পট্ লিখি তায় ফড়িঙের ক’টা ঠ্যাং, আরশুলা কি কি খায়; আঙুলেতে আঠা দিলে কেন লাগে চট্চট্, কাতুকুতু দিলে গরু কেন করে ছট্ফট্। দেখে শিখে প’ড়ে শুনে ব’সে মাথা ঘামিয়ে নিজে নিজে আগাগোড়া লিখে গেছি আমি এ। কান করে কট্কট্ ফোড়া করে টন্টন্— ওরে রামা ছুটে আয়, নিয়ে আয় লণ্ঠন। কাল থেকে মনে মোর লেগে আছে খট্কা, ঝোলাগুড় কিসে দেয়? সাবান না পট্কা— এই বেলা প্রশ্নটা লিখে রাখি গুছিয়ে, জবাবটা জেনে নেব মেজদাকে খুঁচিয়ে। পেট কেন কাম্ড়ায় বল দেখি পার কে? বল দেখি ঝাঁজ কেন জোয়ানের আরকে? তেজপাতে তেজ কেন? ঝাল কেন লঙ্কায়? নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায়? কার নাম দুন্দুভি? কাকে বলে অরণি? বল্বে কি, তোমরাও নটবই পড় নি!ভয় পেয়ো না আবোল তাবোলভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না— সত্যি বলছি কুস্তি ক’রে তোমার সঙ্গে পারব না। মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই, তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই! মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না— জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না? এস এস গর্তে এস, বাস ক’রে যাও চারটি দিন, আদর ক’রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন। হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না? মুগুর আমার হাল্কা এমন মারলে তোমার লাগবে না। অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা? বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা! আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে— সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।ট্যাঁশ্ গরু আবোল তাবোলট্যাঁশ্ গরু গরু নয় আসলেতে পাখি সে; যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে। চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখানা মস্ত, ফিট্ফাট্ কালোচুলে টেরিকাটা চোস্ত। তিন-বাঁকা শিং তার। ল্যাজখানি প্যাঁচান— একটুকু ছোঁও যদি, বাপ্ রে কি চ্যাঁচান! লট্খটে হাড়গোড় খট্খট্ ন’ড়ে যায়, ধমকালে ল্যাগ্ব্যাগ্ চমকিয়ে পড়ে যায়। বর্ণিতে রূপ গুণ সাধ্য কি কবিতার, চেহারার কি বাহার— ঐ দেখ ছবি তার। ট্যাঁশ গরু খাবি খায় ঠ্যাস দিয়ে দেয়ালে, মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে; মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়, মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায়। খায় ন সে দানাপানি— ঘাস পাতা বিচালি, খায় না সে ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি; রুচি নাই আমিষেতে, রুচি নাই পায়সে, সাবানের সূপ আর মোমবতি খায় সে। আর কিছু খেলে তার কাশি ওঠে খক্খক্, সারা গায়ে ঘিন্ঘিন্ ঠ্যাং কাঁপে ঠক্ঠক্। একদিন খেয়েছিল ন্যাক্ড়ার ফালি সে— তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে। কারো যদি শখ্ থাকে ট্যাঁশ্ গরু কিন্তে, শস্তায় দিতে পারি, দেখ ভেবে চিন্তে।ফস্কে গেল আবোল তাবোলদেখ্ বাবাজি দেখ্বি নাকি দেখ্ রে খেলা দেখ্ চালাকি, ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি পড়্ পড়্ পড়্ পড়্বি পাখি— ধপ্! লাফ দিয়ে তাই তালটি ঠুকে তাক্ ক’রে যাই তীর ধনুকে, ছাড়্ব সটান ঊর্ধ্বমুখে হুশ ক’রে তোর লাগ্বে বুকে— খপ্! গুড়্ গুড়্ গুড়্ গুড়িয়ে হামা খাপ্ পেতেছেন গোষ্ঠমামা, এগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা, এইবারে বাণ চিড়িয়া নামা— চট্! ওই যা! গেল ফস্কে ফেঁসে— হেঁই মামা তুই ক্ষেপ্লি শেষে? ঘ্যাঁচ ক’রে তোর পাঁজর ঘেঁষে লাগ্ল কি বাণ ছট্কে এসে— ফট্?পালোয়ান আবোল তাবোলখেলার ছলে ষষ্ঠিচরণ হাতি লোফেন যখন তখন, দেহের ওজন উনিশটি মণ, শক্ত যেন লোহার গঠন। একদিন এক গুণ্ডা তাকে বাঁশ বাগিয়ে মার্ল বেগে— ভাঙল সে বাঁশ শোলার মতো মট্ ক’রে তার কনুই লেগে। এই তো সেদিন রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে দৈব বশে, উপর থেকে প্রকাণ্ড ইঁট পড়ল তাহার মাথায় খ’সে। মুণ্ডুতে তার যেম্নি ঠেকা অম্নি সে ইঁট এক নিমেষে, গুঁড়িয়ে হ’ল ধুলোর মতো, ষষ্ঠি চলেন মুচ্কি হেসে। ষষ্ঠি যখন ধমক হাঁকে কাঁপতে থাকে দালান বাড়ি, ফুঁয়ের জোরে পথের মোড়ে উল্টে পড়ে গরুর গাড়ি। ধুম্সো কাঠের তক্তা ছেঁড়ে মোচড় মেরে মুহূর্তেকে, একশো জালা জল ঢালে রোজ স্নানের সময় পুকুর থেকে। সকাল বেলার জলপানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া, সঙ্গে তারি চৌদ্দ হাঁড়ি দই কি মালাই মুড়কি দেওয়া। দুপুর হলে খাবার আসে কাতার দিয়ে ডেক্চি ভ’রে, বরফ দেওয়া উনিশ কুঁজো সরবতে তার তৃষ্ঞা হরে। বিকাল বেলা খায় না কিছু গণ্ডা দশেক মণ্ডা ছাড়া, সন্ধ্যা হ’লে লাগায় তেড়ে দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া। রাত্রে সে তার হাত-পা টেপায় দশটি চেলা মজুত থাকে, দুম্দুমাদুম্ সবাই মিলে মুগুর দিয়ে পেটায় তাকে। বল্লে বেশি ভাববে শেষে এ-সব কথা ফেনিয়ে বলা— দেখবে যদি আপন চোখে যাও না কেন বেনিয়াটোলা।বিজ্ঞান শিক্ষা আবোল তাবোলআয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি ‘ফুটস্কোপ’ দিয়ে, দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে। কোন দিকে বুদ্ধিটা খোলে, কোন দিকে থেকে যায় চাপা; কতখানি ভস্ ভস্ ঘিলু, কতখানি ঠক্ঠকে ফাঁপা। মন তোর কোন্ দেশে থাকে, কেন তুই ভুলে যাস্ কথা— আয় দেখি কোন্ ফাঁক দিয়ে, মগজেতে ফুটো তোর কোথা। টোল-খাওয়া ছাতাপড়া মাথা ফাটা-মতো মনে হয় যেন, আয় দেখি বিশ্লেষ ক’রে— চোপ্রও ভয় পাস্ কেন? কাৎ হয়ে কান ধ’রে দাঁড়া, জিভখানা উল্টিয়ে দেখা, ভালো ক’রে বুঝে শুনে দেখি— বিজ্ঞানে যেরকম লেখা। মুণ্ডুতে ‘ম্যাগনেট’ ফেলে, বাঁশ দিয়ে ‘রিফ্লেক্ট’ ক’রে, ইঁট দিয়ে ‘ভেলসিটি’ ক’ষে দেখি মাথা ঘোরে কি না ঘোরে।খুচরো ছড়া আবোল তাবোলআকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে, দেখে চেয়ে কত লোক সব কাজ ফেলে; তাই দেখে খুঁতধরা বুড়ো কয় চটে, দেখছ কি, এই রঙ পাকা নয় মোটে॥ ঢপ্ ঢপ্ ঢাক ঢোল ভপ্ ভপ্ বাঁশি, ঝন্ ঝন্ করতাল্ ঠন্ ঠন্ কাঁসি। ধুমধাম বাপ্ বাপ্ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা, বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা॥ শুনেছ কি ব’লে গেল সীতানাথ বন্দ্যো? আকাশের গায়ে নাকি টক্টক্ গন্ধ? টক্টক্ থাকে নাকো হ’লে পরে বৃষ্টি— তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি। কহ ভাই কহ রে, অ্যাঁকাচোরা শহরে, বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না? লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে, ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না! শোন শোন গল্প শোন, ‘এক যে ছিল গুরু,’ এই আমার গল্প হল শুরু। যদু আর বংশীধর যমজ ভাই তারা, এই আমার গল্প হল সারা। মাসি গো মাসি, পাচ্ছে হাসি নিম গাছেতে হচ্ছে শিম্— হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা কাগের বাসায় বগের ডিম॥ বল্ব কি ভাই হুগ্লি গেলুম, বল্ছি তোমায় চুপি চুপি— দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর মাথায় তাদের নেইকো টুপি॥আবোল তাবোল আবোল তাবোলমেঘ মুলুকে ঝাপ্সা রাতে, রামধনুকের আব্ছায়াতে, তাল বেতালে খেয়াল সুরে, তান ধরেছি কণ্ঠ পূরে। হেথায় নিষেধ নাই রে দাদা, নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা। হেথায় রঙিন আকাশতলে স্বপন-দোলা হাওয়ায় দোলে সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে, আকাশকুসুম আপনি ফোটে রঙিয়ে আকাশ, রঙিয়ে মন চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ! আজকে দাদা যাবার আগে বল্ব যা মোর চিত্তে লাগে নাই-বা তাহার অর্থ হোক্ নাই-বা বুঝুক বেবাক্ লোক। আপনাকে আজ আপন হতে ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে। ছুট্লে কথা থামায় কে? আজকে ঠেকায় আমায় কে? আজকে আমার মনের মাঝে ধাঁই ধপাধপ্ তবলা বাজে— রাম-খটাখট্ ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্ কথায় কাটে কথার প্যাঁচ্। আলোয় ঢাকা অন্ধকার, ঘণ্টা বাজে গন্ধে তার। গোপন প্রাণে স্বপন দূত, মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভূত! হ্যাংলা হাতি চ্যাং-দোলা, শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা। মক্ষিরানী পক্ষিরাজ— দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ। আদিম কালের চাঁদিম হিম, তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম। ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর, গানের পালা সাঙ্গ মোর।Madhab Jana📞7548901565Nankar MaguraNarayangarhPaschim MedinipurWest BengalPin no-721437
0 Comments